Friday, October 11, 2013

কারো কম্পিউটারে অনুমতি ছাড়া ঢুকলে ১৪ বছর জেল


নিজস্ব প্রতিবেদক: আপনি যদি অন্য কারো কম্পিউটারে তার অনুমতি ব্যাতিরেকে প্রবেশ করেন বা অন্য কোন ব্যক্তিকে প্রবেশ করতে সহায়তা করেন তাহলে আপনার ৭ থেকে ১৪ বছরের জেল হতে পারে। শুধু তাই নয় এই অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় আপনি জামিনও পাবেন না। এমনকি বিনা পরোয়ানায় পুলিশ আপনাকে গ্রেফতার করতে পারবে। ২০১৩ সালে সংশোধিত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ এ এই বিধান করা হয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞরা এটিকে একটি বিপজ্জনক আইন বলে অভিহিত করেছেন।আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এর মাধ্যমে তরুণ সমাজকে একটি ভীতিকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। এই আইনের সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে ৫৭ ধারা। এই ধারাকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যার কারণে ইন্টারনেটের যে কোন কর্মকাণ্ডকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া সংবাদপত্রের অনলাইনে বা ওয়েবসাইট বা ফেসবুকে বা ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে প্রকাশ বা সম্প্রচার করা কোন কিছু মিথ্যা বলে প্রমাণিত হলে একই দণ্ড হবে। আপনার বিরুদ্ধে যদি মিথ্যা অভিযোগও হয় তবু মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আপনার জামিন মিলছে না।
বিগত বিএনপি সরকারের আমলে ২০০৬ সালে জাতীয় সংসদে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন পাস হয়। সে সময় এই আইনে সর্বনিম্ন কারাদণ্ডের সময়সীমা ছিল না। ফলে অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী যে কোন ধরনের দণ্ড প্রদানের ক্ষমতা আদালতের ছিলো। কিন্তু ২০১৩ সালে সংশোধিত এই আইনে যে কোন অপরাধের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন সাজা নির্ধারণ করা হয়েছে সাত বছর। ২০০৬ সালের মূল আইনে আদালতের ওপর জামিনের ক্ষমতা ন্যস্ত ছিলো। অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী আদালত যে কোন পর্যায়ে আসামিকে জামিন দিতে পারত। কিন্তু ২০১৩ সালের আইনে এই আইনের অধীনে অপরাধসূমহ অজামিনযোগ্য এবং আমলযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে আপনি যদি বৃদ্ধ, পক্ষাঘাতগ্রস্ত কিংবা নির্দোষও হন তাহলে মামলার বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত জামিন মিলছে না। এছাড়া অপরাধ আমলযোগ্য হওয়ায় আদালতের পরোয়ানা ছাড়াই পুলিশ যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারবে।
এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজীব উল আলম বলেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের মূল সমস্যা (প্রতিবন্ধকতা) হচ্ছে ৫৭ ধারা। এই আইনে অপরাধ সংঘটনের যে বর্ণনা দেয়া আছে তাতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অর্থাত্ ৫৭ ধারায় এমনভাবে অপরাধ সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যেমন ইন্টারনেটে যে কোন কর্মকাণ্ডকেই এই আইনের আওতায় অপরাধ হিসেবে গণ্য করার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েই আছে। এরকম একটি আইনে এতদিন যে রক্ষাকবচ (সেফগার্ড) ছিল এই সরকারের আনীত সংশোধনীর ফলে সেটিও উঠে গেছে। অর্থাত্ এতদিন মামলা করতে হলে সরকারের অনুমতির প্রয়োজন হতো। এখন আর অনুমতির প্রয়োজন লাগবে না।
ব্যারিস্টার তানজীব বলেন, মানুষের বাক স্বাধীনতার জায়গাটি- সংবিধানে যেটিকে মৌলিক অধিকার হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে সেই অধিকার হরণ হয়েছে চরমভাবে। এই আইন আপনাকে ইন্টারনেটে ব্লগিং বা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে বারণ করছে না। কিন্তু যখন আপনি একাজগুলো করতে যাবেন তখনই আপনার মনে এক ধরনের ভীতি কাজ করবে। ওই ভীতি কাজ করা বা ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করাটাই তো বাক স্বাধীনতার পরিপন্থী। বাক স্বাধীনতার মত যেসব মৌলিক অধিকার আছে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমার মধ্যে কি ধরনের ভীতি কাজ করছে। আমি তো মনে করি এই আইনে এক ধরনের ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে আছে। যা আমাদের বাক স্বাধীনতাকে খর্ব করছে। যেহেতু বাক স্বাধীনতা খর্ব করছে সেহেতু আইনটি সংবিধান বিরোধী। এক কথায় যদি বলি তাহলে এই আইনের ৫৭ ধারা সংবিধান বিরোধী। এই সংবিধান বিরোধী আইনে পুলিশকে দেয়া হয়েছে ব্যাপক ক্ষমতা। যা মানুষের বাক স্বাধীনতাকে হরণ করবে।
সংবিধানে বলা আছে আইনের চোখে সবাই সমান। এখন বর্তমান আইনানুযায়ী সংবাদপত্রের অনলাইনে মিথ্যা কোন কিছু প্রকাশ করা হলে ন্যূনতম সাজা হবে ৭ বছর।
ব্যারিস্টার তানজীব বলেন, আগের আইনে সর্বোচ্চ সাজার বিষয়টি উল্লেখ ছিল। কিন্তু ন্যূনতম সাজার বিষয়টি ছিলো না। কারণ জুতা চুরির জন্য তো কারো ফাঁসি হতে পারে না! চুরির অপরাধের জন্য যে সাজা সেই সাজাই তার প্রাপ্য হবে। কিন্তু এখন যদি আপনি বলেন, ফেসবুকে আপনার দেয়া স্ট্যাটাসের ফলে কারো মানহানি হয়েছে তাহলে মানহানির পরিমাণ অনুযায়ী সেই পরিমাণ শাস্তি হতে পারত। মানহানি কতটুকু হয়েছে সেটি তো আদালতের বিচার্য বিষয়। কিন্তু এই আইনে ন্যূনতম সাজা ৭ বছর উল্লেখ করে দিয়ে কোর্টের হাত-পা বেঁধে দেয়া হয়েছে। কারণ কাউকে যদি সাজা দিতে হয়, তাহলে তাকে ৭ বছর সাজা দিতে হবে। ন্যূনতম সাজার বিধান করে নাগরিকদের এক ধরনের অসহায় অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, সংশোধনীতে আইনের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্বলিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইন্টারনেট ব্যবহার বৃদ্ধি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে আরো এগিয়ে নেয়ার জন্য এই আইন। কিন্তু আইনে শাস্তির পরিমাণ বাড়িয়ে কিভাবে আপনি এর ব্যবহারকে বৃদ্ধি করবেন? কিভাবে জনগণকে ডিজিটালাইজেশনে উত্সাহিত করবেন? যখন ইন্টারনেট ব্লগিং বা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলে শাস্তি হবে, তখন কেউ কি আর দ্বিগুণ উত্সাহ নিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করবেন?
ব্যারিস্টার তানজীব বলেন, সিলেকটিভ অ্যাপলিকেশন অব ল এর তৈরি হয়েছে এই সংশোধনীর ফলে। কারণ আপনার যাকে পছন্দ হলো না তাকে ধরলেন এবং সাজার ব্যবস্থা করলেন আর যাকে পছন্দ হল তাকে ধরলেন না- এতে করে আপনি রিপ্রেশনের জন্য আইনটিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করলেন। কিন্তু আইনের আসল উদ্দেশ্য কখনোই এটি হওয়া উচিত নয়। রাষ্ট্রের এ ধরনের পদক্ষেপের ফলে জনগণের সঙ্গে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়। যা গণতন্ত্রের জন্য কখনো শুভ ফল বয়ে আনতে পারে না। মনে হচ্ছে সরকারের শেষ মুহূর্তে এসে সরকারের মধ্যেই কিছু কিছু লোক এমন সব পদক্ষেপ নেয়াচ্ছে যেগুলো আসলেই জনবিরোধী।
তিনি বলেন, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা তরুণ প্রজন্ম। আইনে সংশোধনী এনে এই প্রজন্মকে ভীতিকর পরিবেশের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। অর্থাত্ একটি প্রজন্মকে আপনার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন। এই আইন দিয়ে তো কোন কিছু অর্জন করতে পারবেন না। কিন্তু জনগণের অনুভূতিতে আঘাত করলেন। এটা গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট এম আসাদুজ্জামান বলেন, মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার সমাজ বিনির্মাণে এই আইন একটি বড় বাধা হয়ে দেখা দেবে। পুলিশকে যে অসীম ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তাতে পুলিশকে আরো বেপরোয়া করবে। পুলিশ চাইলে যে কাউকেই এই আইনে মামলা দিয়ে দীর্ঘকাল কারাগারে রাখতে পারবে।
এই আইনের অপরাধসূমহ
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৪ থেকে ৬৫ ধারা পর্যন্ত কোন কোন কর্মকাণ্ড অপরাধ তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৫৪ ধারায় উল্লেখ রয়েছে, (১) যদি কোন ব্যক্তি কোন কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কের মালিক বা জিম্মাদারের অনুমতি ব্যতিরেকে-
(ক) তার ফাইলে রক্ষিত তথ্য বিনষ্ট করার বা ফাইল থেকে তথ্য উদ্ধার বা সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে ঐ কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কে প্রবেশ করেন বা অন্য কোন ব্যক্তিকে প্রবেশ করতে সহায়তা করেন;
(খ) কোন কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্ক থেকে কোন উপাত্ত, উপাত্ত-ভাণ্ডার বা তথ্য বা তার উদ্ধৃতাংশ সংগ্রহ করেন বা স্থানান্তরযোগ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থায় রক্ষিত বা জমাকৃত তথ্য (removable storage medium) বা উপাত্তসহ ঐ কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কের তথ্য সংগ্রহ করেন বা কোন উপাত্তের অনুলিপি বা অংশ বিশেষ সংগ্রহ করেন;
(গ) কোন কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোন ধরনের কম্পিউটার সংক্রামক বা দূষক বা কম্পিউটার ভাইরাস প্রবেশ করান বা প্রবেশ করানোর চেষ্টা করেন;
(ঘ) ইচ্ছাকৃতভাবে কোন কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, উপাত্ত, কম্পিউটারের উপাত্ত-ভাণ্ডারের ক্ষতিসাধন করেন বা ক্ষতিসাধনের চেষ্টা করেন বা ঐ কম্পিউটার, সিস্টেম বা নেটওয়ার্কে রক্ষিত অন্য কোন প্রোগ্রামের ক্ষতি সাধন করেন বা করার চেষ্টা করেন;
(ঙ) ইচ্ছাকৃতভাবে কোন কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম বা নেটওয়ার্কে বিঘ্ন সৃষ্টি করেন বা করার চেষ্টা করেন;
(চ) কোন কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কে কোন বৈধ বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে কোন উপায়ে প্রবেশ করতে বাধা সৃষ্টি করেন বা করার চেষ্টা করেন;
৫৫ ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে, কোন কম্পিউটার, কম্পিউটার প্রোগ্রাম, কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কে ব্যবহূত কম্পিউটার সোর্স কোড, গোপন, ধ্বংস বা পরিবর্তন করেন, বা অন্য কোন ব্যক্তির মাধ্যমে ঐ কোড, প্রোগ্রাম, সিস্টেম বা নেটওয়ার্ক গোপন, ধ্বংস বা পরিবর্তন করার চেষ্টা করেন এবং ঐ সোর্স কোডটি যদি আপাততঃ বলবত্ অন্য কোন আইন দ্বারা সংরক্ষণযোগ্য বা রক্ষণাবেক্ষণযোগ্য হয়, তাহলে তাহার এই কাজ হবে একটি অপরাধ?
৫৭ ধারায় বলা আছে, (১) কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েব সাইটে বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সমপ্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসত্ কাজে আগ্রহী হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহলে তার এই কাজ হবে একটি অপরাধ?

কারো কম্পিউটারে অনুমতি ছাড়া ঢুকলে ১৪ বছর জেল


নিজস্ব প্রতিবেদক: আপনি যদি অন্য কারো কম্পিউটারে তার অনুমতি ব্যাতিরেকে প্রবেশ করেন বা অন্য কোন ব্যক্তিকে প্রবেশ করতে সহায়তা করেন তাহলে আপনার ৭ থেকে ১৪ বছরের জেল হতে পারে। শুধু তাই নয় এই অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় আপনি জামিনও পাবেন না। এমনকি বিনা পরোয়ানায় পুলিশ আপনাকে গ্রেফতার করতে পারবে। ২০১৩ সালে সংশোধিত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ এ এই বিধান করা হয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞরা এটিকে একটি বিপজ্জনক আইন বলে অভিহিত করেছেন।আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এর মাধ্যমে তরুণ সমাজকে একটি ভীতিকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। এই আইনের সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে ৫৭ ধারা। এই ধারাকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যার কারণে ইন্টারনেটের যে কোন কর্মকাণ্ডকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া সংবাদপত্রের অনলাইনে বা ওয়েবসাইট বা ফেসবুকে বা ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে প্রকাশ বা সম্প্রচার করা কোন কিছু মিথ্যা বলে প্রমাণিত হলে একই দণ্ড হবে। আপনার বিরুদ্ধে যদি মিথ্যা অভিযোগও হয় তবু মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আপনার জামিন মিলছে না।
বিগত বিএনপি সরকারের আমলে ২০০৬ সালে জাতীয় সংসদে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন পাস হয়। সে সময় এই আইনে সর্বনিম্ন কারাদণ্ডের সময়সীমা ছিল না। ফলে অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী যে কোন ধরনের দণ্ড প্রদানের ক্ষমতা আদালতের ছিলো। কিন্তু ২০১৩ সালে সংশোধিত এই আইনে যে কোন অপরাধের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন সাজা নির্ধারণ করা হয়েছে সাত বছর। ২০০৬ সালের মূল আইনে আদালতের ওপর জামিনের ক্ষমতা ন্যস্ত ছিলো। অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী আদালত যে কোন পর্যায়ে আসামিকে জামিন দিতে পারত। কিন্তু ২০১৩ সালের আইনে এই আইনের অধীনে অপরাধসূমহ অজামিনযোগ্য এবং আমলযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে আপনি যদি বৃদ্ধ, পক্ষাঘাতগ্রস্ত কিংবা নির্দোষও হন তাহলে মামলার বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত জামিন মিলছে না। এছাড়া অপরাধ আমলযোগ্য হওয়ায় আদালতের পরোয়ানা ছাড়াই পুলিশ যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারবে।
এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজীব উল আলম বলেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের মূল সমস্যা (প্রতিবন্ধকতা) হচ্ছে ৫৭ ধারা। এই আইনে অপরাধ সংঘটনের যে বর্ণনা দেয়া আছে তাতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অর্থাত্ ৫৭ ধারায় এমনভাবে অপরাধ সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যেমন ইন্টারনেটে যে কোন কর্মকাণ্ডকেই এই আইনের আওতায় অপরাধ হিসেবে গণ্য করার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েই আছে। এরকম একটি আইনে এতদিন যে রক্ষাকবচ (সেফগার্ড) ছিল এই সরকারের আনীত সংশোধনীর ফলে সেটিও উঠে গেছে। অর্থাত্ এতদিন মামলা করতে হলে সরকারের অনুমতির প্রয়োজন হতো। এখন আর অনুমতির প্রয়োজন লাগবে না।
ব্যারিস্টার তানজীব বলেন, মানুষের বাক স্বাধীনতার জায়গাটি- সংবিধানে যেটিকে মৌলিক অধিকার হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে সেই অধিকার হরণ হয়েছে চরমভাবে। এই আইন আপনাকে ইন্টারনেটে ব্লগিং বা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে বারণ করছে না। কিন্তু যখন আপনি একাজগুলো করতে যাবেন তখনই আপনার মনে এক ধরনের ভীতি কাজ করবে। ওই ভীতি কাজ করা বা ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করাটাই তো বাক স্বাধীনতার পরিপন্থী। বাক স্বাধীনতার মত যেসব মৌলিক অধিকার আছে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমার মধ্যে কি ধরনের ভীতি কাজ করছে। আমি তো মনে করি এই আইনে এক ধরনের ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে আছে। যা আমাদের বাক স্বাধীনতাকে খর্ব করছে। যেহেতু বাক স্বাধীনতা খর্ব করছে সেহেতু আইনটি সংবিধান বিরোধী। এক কথায় যদি বলি তাহলে এই আইনের ৫৭ ধারা সংবিধান বিরোধী। এই সংবিধান বিরোধী আইনে পুলিশকে দেয়া হয়েছে ব্যাপক ক্ষমতা। যা মানুষের বাক স্বাধীনতাকে হরণ করবে।
সংবিধানে বলা আছে আইনের চোখে সবাই সমান। এখন বর্তমান আইনানুযায়ী সংবাদপত্রের অনলাইনে মিথ্যা কোন কিছু প্রকাশ করা হলে ন্যূনতম সাজা হবে ৭ বছর।
ব্যারিস্টার তানজীব বলেন, আগের আইনে সর্বোচ্চ সাজার বিষয়টি উল্লেখ ছিল। কিন্তু ন্যূনতম সাজার বিষয়টি ছিলো না। কারণ জুতা চুরির জন্য তো কারো ফাঁসি হতে পারে না! চুরির অপরাধের জন্য যে সাজা সেই সাজাই তার প্রাপ্য হবে। কিন্তু এখন যদি আপনি বলেন, ফেসবুকে আপনার দেয়া স্ট্যাটাসের ফলে কারো মানহানি হয়েছে তাহলে মানহানির পরিমাণ অনুযায়ী সেই পরিমাণ শাস্তি হতে পারত। মানহানি কতটুকু হয়েছে সেটি তো আদালতের বিচার্য বিষয়। কিন্তু এই আইনে ন্যূনতম সাজা ৭ বছর উল্লেখ করে দিয়ে কোর্টের হাত-পা বেঁধে দেয়া হয়েছে। কারণ কাউকে যদি সাজা দিতে হয়, তাহলে তাকে ৭ বছর সাজা দিতে হবে। ন্যূনতম সাজার বিধান করে নাগরিকদের এক ধরনের অসহায় অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, সংশোধনীতে আইনের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্বলিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইন্টারনেট ব্যবহার বৃদ্ধি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে আরো এগিয়ে নেয়ার জন্য এই আইন। কিন্তু আইনে শাস্তির পরিমাণ বাড়িয়ে কিভাবে আপনি এর ব্যবহারকে বৃদ্ধি করবেন? কিভাবে জনগণকে ডিজিটালাইজেশনে উত্সাহিত করবেন? যখন ইন্টারনেট ব্লগিং বা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলে শাস্তি হবে, তখন কেউ কি আর দ্বিগুণ উত্সাহ নিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করবেন?
ব্যারিস্টার তানজীব বলেন, সিলেকটিভ অ্যাপলিকেশন অব ল এর তৈরি হয়েছে এই সংশোধনীর ফলে। কারণ আপনার যাকে পছন্দ হলো না তাকে ধরলেন এবং সাজার ব্যবস্থা করলেন আর যাকে পছন্দ হল তাকে ধরলেন না- এতে করে আপনি রিপ্রেশনের জন্য আইনটিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করলেন। কিন্তু আইনের আসল উদ্দেশ্য কখনোই এটি হওয়া উচিত নয়। রাষ্ট্রের এ ধরনের পদক্ষেপের ফলে জনগণের সঙ্গে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়। যা গণতন্ত্রের জন্য কখনো শুভ ফল বয়ে আনতে পারে না। মনে হচ্ছে সরকারের শেষ মুহূর্তে এসে সরকারের মধ্যেই কিছু কিছু লোক এমন সব পদক্ষেপ নেয়াচ্ছে যেগুলো আসলেই জনবিরোধী।
তিনি বলেন, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা তরুণ প্রজন্ম। আইনে সংশোধনী এনে এই প্রজন্মকে ভীতিকর পরিবেশের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। অর্থাত্ একটি প্রজন্মকে আপনার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন। এই আইন দিয়ে তো কোন কিছু অর্জন করতে পারবেন না। কিন্তু জনগণের অনুভূতিতে আঘাত করলেন। এটা গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট এম আসাদুজ্জামান বলেন, মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার সমাজ বিনির্মাণে এই আইন একটি বড় বাধা হয়ে দেখা দেবে। পুলিশকে যে অসীম ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তাতে পুলিশকে আরো বেপরোয়া করবে। পুলিশ চাইলে যে কাউকেই এই আইনে মামলা দিয়ে দীর্ঘকাল কারাগারে রাখতে পারবে।
এই আইনের অপরাধসূমহ
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৪ থেকে ৬৫ ধারা পর্যন্ত কোন কোন কর্মকাণ্ড অপরাধ তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৫৪ ধারায় উল্লেখ রয়েছে, (১) যদি কোন ব্যক্তি কোন কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কের মালিক বা জিম্মাদারের অনুমতি ব্যতিরেকে-
(ক) তার ফাইলে রক্ষিত তথ্য বিনষ্ট করার বা ফাইল থেকে তথ্য উদ্ধার বা সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে ঐ কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কে প্রবেশ করেন বা অন্য কোন ব্যক্তিকে প্রবেশ করতে সহায়তা করেন;
(খ) কোন কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্ক থেকে কোন উপাত্ত, উপাত্ত-ভাণ্ডার বা তথ্য বা তার উদ্ধৃতাংশ সংগ্রহ করেন বা স্থানান্তরযোগ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থায় রক্ষিত বা জমাকৃত তথ্য (removable storage medium) বা উপাত্তসহ ঐ কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কের তথ্য সংগ্রহ করেন বা কোন উপাত্তের অনুলিপি বা অংশ বিশেষ সংগ্রহ করেন;
(গ) কোন কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোন ধরনের কম্পিউটার সংক্রামক বা দূষক বা কম্পিউটার ভাইরাস প্রবেশ করান বা প্রবেশ করানোর চেষ্টা করেন;
(ঘ) ইচ্ছাকৃতভাবে কোন কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, উপাত্ত, কম্পিউটারের উপাত্ত-ভাণ্ডারের ক্ষতিসাধন করেন বা ক্ষতিসাধনের চেষ্টা করেন বা ঐ কম্পিউটার, সিস্টেম বা নেটওয়ার্কে রক্ষিত অন্য কোন প্রোগ্রামের ক্ষতি সাধন করেন বা করার চেষ্টা করেন;
(ঙ) ইচ্ছাকৃতভাবে কোন কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম বা নেটওয়ার্কে বিঘ্ন সৃষ্টি করেন বা করার চেষ্টা করেন;
(চ) কোন কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কে কোন বৈধ বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে কোন উপায়ে প্রবেশ করতে বাধা সৃষ্টি করেন বা করার চেষ্টা করেন;
৫৫ ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে, কোন কম্পিউটার, কম্পিউটার প্রোগ্রাম, কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কে ব্যবহূত কম্পিউটার সোর্স কোড, গোপন, ধ্বংস বা পরিবর্তন করেন, বা অন্য কোন ব্যক্তির মাধ্যমে ঐ কোড, প্রোগ্রাম, সিস্টেম বা নেটওয়ার্ক গোপন, ধ্বংস বা পরিবর্তন করার চেষ্টা করেন এবং ঐ সোর্স কোডটি যদি আপাততঃ বলবত্ অন্য কোন আইন দ্বারা সংরক্ষণযোগ্য বা রক্ষণাবেক্ষণযোগ্য হয়, তাহলে তাহার এই কাজ হবে একটি অপরাধ?
৫৭ ধারায় বলা আছে, (১) কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েব সাইটে বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সমপ্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসত্ কাজে আগ্রহী হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহলে তার এই কাজ হবে একটি অপরাধ?